ডেক্স: শুক্রবার চৌকিদিঘি টু এয়ারপোর্ট রোডের ফাঁকা রাস্তা। হঠাৎ অনেক দূর থেকে ভেসে এলো বুম বুম শব্দ। সেই শব্দে লোকজন চোখ তুলে তাকানোর আগেই বাতাসে শিস দিয়ে ছুটে চলে গেলো একটা ঝকঝকে মোটরবাইক। পথচারীরা ‘বাহ!’ বলার আগেই চোখের আড়ালেই চলে গেছে গাড়ীটি। শৌখিন তরুণদের এই বাহনটি ষোলআনা আধুনিক। দেখতে পেশিবহুল, চলে দূরন্ত গতিতে।
নগরীতে এভাবেই এখন মূর্তিমান এক আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে বেপরোয়া গতির মোটর সাইকেল। প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। আর এতে প্রাণ হারাতে হচ্ছে মোটরসাইকেল আরোহী কিংবা পথচারীদের। পুলিশ বলছে, ট্রাফিক আইন না মানা, বেপরোয়া গতি, অদক্ষ চালকসহ নানা কারণে ঘটছে এসব দুর্ঘটনা।
এ রকমই একটি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা জানালেন একটি বেসরকারী অফিসের কর্তকর্তা সুমাইয়া আক্তার (ছদ্ম নাম)। তিনি শুক্রবার বিকেলে নগরের উপশহরে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আচমকাই তার পাশ দিয়ে কান ফাটানো শব্দ দিয়ে বেপরোয়া গতিতে কয়েকটি মোটরসাইকেল চলে গেলো। সাইলেন্সার খুলা এই দুই চাকার মোটরবাইকের শব্দে আঁতকে ওঠেন তিনি। সাথে থাকা ছোট্ট ছেলেও ভয়ে কান্না শুরু করে।
সুমাইয়া বলেন, ৮/১০টি মোটরসাইকেল একসাথে যারা মোটরবাইক চালাচ্ছে এদের বয়স কম। খুব বেশি হলে উনিশ থেকে ২০ বছর হবে। একসাথে ৮/১০টি মোটরসাইকেলর হর্ণ বাজিয়ে চলে যায়। তাদের বিকট শব্দের কারণে আমি নিজে ভয় পাই এবং আমার ছোট্ট বাচ্চাটাও ভয়ে কান্না শুরু করে।
ইদানিং নগরীর অধিকাংশ এলাকায় সুমাইয়ার মতো অনেক নারী-পুরুষকে এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এরপরও সংশ্লিষ্টদের তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি।
দেখা গেছে, নগরীতে নিয়মমতো ট্রাফিক সিগন্যালে সব গাড়িই দাঁড়ায়। শুধু নিয়ম যেন নেই মোটরসাইকেলের। কখনো এগিয়ে চলে একেবেঁকে ফুটপাত দিয়ে। কখনো উল্টো পথে, আবার কখনো বিপজ্জনক গতিতে মোটরসাইকেল আরোহীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নগরজুড়ে। শুধু ফুটপাতই নয়, রাজপথেও এখন আতঙ্ক এই দুই চাকার গাড়ী। মোটরসাইকেল আরোহীদের প্রতিদিনকার এই উৎপাতে সাধারণ পথচারীদের মধ্যে ক্ষোভের অন্ত নেই।
সুত্র জানায়, বড়লোকের বখে যাওয়া এসব সন্তানেদের প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে নগরের বাসিন্দারা। গাড়ির সাইলেন্সারের পাইপ খুলে দিয়ে বিকট শব্দ তুলে নগরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। আবার কেউ কেউ গাড়িতে লাগিয়েছে ভিআইপি হর্ন। তারা বিকাল গড়াতেই বিভিন্ন ব্যস্ততম রাস্তায় রেসিংয়ে মত্ত থাকছে। এতে প্রায়ই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। রাস্তায় চলন্ত গাড়ির ঠিক পেছনে গিয়ে বিকট শব্দ-ছড়ানো হর্ন বাজিয়ে সামনের গাড়ির চালককে হঠাৎ তটস্থ করে দিচ্ছেন তারা।
শুধু গাড়ীর চালক নয়, এসব হর্ন হঠাৎ বেজে ওঠলে যে কেউ আঁতকে ওঠেন। বিশেষ করে কাজিরবাজার ব্রিজ, আখালিয়া-ত্রিমুখী সড়ক, বাইপাস, এয়াপোর্ট সড়কে তাদের দৌরাত্ম বেশি। এসব সড়ক ছাড়াও নগরের অধিকাংশ সড়কসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সড়কেও তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কম বয়সী এসব তরুণ ও যুবকরা দিনের বেলায় ব্যস্ত থাকছে তরুণী উত্ত্যক্তকরণের মতো অপরাধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদেরই একজন জানায়, এ ধরনের শব্দ করলে আলাদা মনোযোগ তৈরি করা যায়। পথে চলতি অবস্থায় ভয়ে অনেকে সাইড দিয়ে দেয়। আর গাড়ি স্পিডে চালালে নিজেকে ‘স্মার্ট’ মনে হয়। পাশাপাশি মেয়েদের দৃষ্টিতে পড়া যায়।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এসএমপি’র অ্যাক্টের ধারায় বলা হয়েছে, যদি মোটরযানে এমন ধরনের হর্ন বা শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্র সংযোজন বা ব্যবহার করে তা হলে নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ একশ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে। কিন্তু এ আইনের বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। তাছাড়া সীমিত অঙ্কের জরিমানার বিধান থাকায় ধনীর দুলালরা এসবকে পাত্তাও দেয় না।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে মহানগর ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রাস্তাঘাটে বিরক্ত সৃষ্টিকারী শব্দ-ধোঁয়ার গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মোটরযান অধ্যাদেশে মামলা, জরিমানা আদায় ও আদালতে সোপর্দ করারও বিধান আছে।
ইদানীং রাস্তাঘাটে বিকট শব্দযুক্ত হর্ন ব্যবহারের কথা স্বীকার করে ওই ট্রাফিক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় তাদের আটকালে পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। দেখা যায়, যে ব্যক্তিকে আটকানো হয়ে সে ফোন ধরিয়ে দেয় নেতাদের কিংবা আমাদেরই ট্রাফিক বিভাগের অনেক অফিসারের সাথে। ফলে বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) ফয়সল মাহমুদ বলেন, যারা মোটরবাইক চালান, এদের অধিকাংশদের বয়স কম। তাদের মধ্যে একটা অসহিষ্ণুতা বরাবরই থাকে। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় ট্রাফিক সিগন্যালে আসলে তারা বিকট শব্দের হর্ণটি বাজায় না। অন্য এলাকায় যদি কেউ উচ্চ শব্দে গাড়ি চালালে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে তা বের করা সম্ভব নয়। আর যদি কেউ ধরা পড়ে তবে টহল পুলিশের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং নেয়া হবে।
ফয়সল মাহমুদ আরো বলেন, মহানগর ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। দেয়া হয় মামলা। অনেক সময় গাড়ী রেকারও করা হয়।